খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৬শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল ৩ দিনের রিমান্ডে
  শহিদ আবু সাঈদ হত্যা মামলা : তদন্তে মিলেছে ৩০ জনের সম্পৃক্ততা মিলেছে
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন

২০০৯ সালে হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্ব ছিল অবৈধ

গেজেট ডেস্ক

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে মিথ্যা হলফনামা দিয়ে সংসদ সদস্য হন। দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তিনি সম্পদের তথ্য গোপন করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে তিনি অযোগ্য ছিলেন। তার সংসদ সদস্য পদ ছিল অবৈধ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নিয়োগ ছিল অবৈধ এবং একই কারণে ২০০৯ সালে তার নেতৃত্বে গঠিত সরকারটিও ছিল অবৈধ।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ব্যাপক তদন্তে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তদন্তে বের হয়, শেখ হাসিনা স্থাবর সম্পদ হিসেবে ২১ দশমিক ৯১ একর জমির তথ্য গোপন করেছেন। দুই কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৭৬ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ লুকিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি এক কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের আমদানি করা মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির তথ্যও গোপন করেছেন। বেনামে গাড়িটি ক্রয়ে তিনি জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. মাসুদুর রহমান বিষয়টি তদন্ত করেছেন। তদন্ত শেষে সুপারিশে দুদক আইনের দুটি ধারায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে বলা হয়। ২০০৮-পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা আর কোনো অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন কি না, তা নতুন করে তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়।

বেনামে শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার কেলেঙ্কারির জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৮ সালের নির্বাচনি হলফনামায় তথ্য গোপন করার বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পৌঁছে গেছে। নির্বাচন কমিশন তা পর্যালোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে।

দুদকের আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনি হলফনামা ছাড়াও ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের হলফনামায় দেওয়া শেখ হাসিনার সম্পদ বিবরণী তদন্তেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

দুদকের তদন্তে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার মিথ্যা হলফনামার বিষয়টি তৎকালীন সিইসি ড. শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন অবহিত হওয়া সত্ত্বেও চেপে যায়। তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীও এ ঘটনা জানতেন। দুদকে ফাইলটি তখন ধামাচাপা দেওয়া হয় (ক্লোজ করা হয়)। এ বিষয়ে হাসান মশহুদ চৌধুরীর বক্তব্য জানার জন্য ফোনে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত। কাউকে চেনেন না এবং কথা বলতেও অসুবিধা হয়।

শেখ হাসিনার মিথ্যা হলফনামা, সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপন ও জালিয়াতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের যাবতীয় কাগজপত্র আমার দেশ পেয়েছে। সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থিতার পূর্বশর্ত হলো হলফনামার মাধ্যমে দাখিল করা সম্পদ বিবরণী। এতে পরিসম্পদ ও দায় উভয়ই যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হতে হয়। নির্বাচন আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ অনুযায়ী সংগত কারণেই হলফনামায় মিথ্যাচারে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ১৯ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে হলফনামার মাধ্যমে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। তাতে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নিজ নামে এবং যৌথ মালিকানার অংশ হিসেবে তার অর্জিত জমির পরিমাণ দেখান ৬ দশমিক ৫০ একর। তদন্তে শেখ হাসিনার স্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ২৮ দশমিক ৪১ একর জমি। অর্থাৎ দাখিল করা হলফনামায় নিজ নামে অর্জিত ২১ দশমিক ৯১ একর স্থাবর সম্পত্তি তিনি গোপন করেন। ২০০৭ সালের ৩০ জুন সময়কালে আয়কর নথিতে দেখানো রিটার্ন অনুযায়ী স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য দেখান তিন কোটি ৩৫ লাখ ২১ হাজার ১৮৮ টাকা। কিন্তু তদন্তে তার পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৭৬ হাজার ১৬৪ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা দুই কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৭৬ টাকার তথ্য গোপন করেন।

দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেনের কাছে মিথ্যা হলফনামা ও সম্পদ গোপন এবং দুদকের তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের সত্যনিষ্ঠ অনুসন্ধানে প্রমাণ হয়েছে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা হলফ করে নির্বাচন কমিশনে যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন, তা যথার্থ ছিল না। তাতে বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ লুকানো হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন প্রামাণিক দলিলের ভিত্তিতেই অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে থাকে। ২০০৮ সালের তদন্ত প্রতিবেদনকে মূল ধরে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ২০২৫ সালের ২১ মে দুদক অনুরোধ করে। কমিশন ওই প্রার্থীর (শেখ হাসিনা) নির্বাচনি বৈধতার ওপর সিদ্ধান্ত দেবে।

শাস্তির বিষয়ে কী পদক্ষেপ হতে পারে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, ব্যক্তি হিসেবে এবং আইন ও প্রশাসনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মনে করি, নির্বাচনি অযোগ্যতার কারণে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সংসদ সদস্য পদ রাখার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না এবং নেই। সেক্ষেত্রে তার প্রধানমন্ত্রিত্বেরও বৈধতা নেই। সংগত কারণেই তার সরকারও অবৈধ বিবেচিত হওয়ার কথা।

২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়কালের কমিশনের বক্তব্য

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কালে নির্বাচন কমিশনে ছিলেন সিইসি এটিএম শামসুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সাবেক সিইসি ড. শামসুল হুদার মোবাইলে ফোন করলে তার স্ত্রী রিসিভ করেন। বলেন, তিনি খুবই অসুস্থ। এখন ঘুমাচ্ছেন। কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। ওই সময়কার নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন আমার দেশকে বলেন, আমরা অত্যন্ত সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। দায়িত্ব পালনে আমরা সবার কাছে ওপেন ছিলাম। কাজেই কোনো তথ্যে গরমিল থাকলে নিশ্চয়ই বের হয়ে আসত। আর ওই সময় হলফনামায় কোনো তথ্য গোপনের অভিযোগও আমাদের কাছে আসেনি।

হলফনামায় শেখ হাসিনার তথ্য গোপনের বিষয়টি কমিশন ইচ্ছা করে চেপে গিয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বয়স এখন ৮৬ বছর। ১৫-১৬ বছর আগের ঘটনা এখন সবটা মনে করতে পারছি না।

বিশেষজ্ঞ মত

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম আমার দেশকে বলেন, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে আইন অনুযায়ী নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। সে হিসেবে শেখ হাসিনা যদি ২০০৮ সালের নির্বাচনি হলফনামায় তথ্য গোপন করে থাকেন, তাহলে তার প্রার্থিতা বাতিল হওয়ারই কথা ছিল। ফলে প্রার্থী হতে না পারলে সংসদ সদস্য বা পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীÑকোনোটিই তার হওয়ার সুযোগ ছিল না।

এ প্রসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম আরো বলেন, আমরা দেখি নির্বাচনের সময় হলফনামা দাখিল করা হয়। কিন্তু এটি যথাযথভাবে যাচাই করা হয় না। এজন্য নির্বাচন কমিশন, এনবিআর ও দুদকের মধ্যে সমন্বয় দরকার। আমরা সংস্কার কমিশন থেকে এ বিষয়ে একটি সুপারিশও করেছি।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারপ্রধান হওয়া একটা জঘন্য অপরাধ। কিন্তু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাই করেছিলেন। সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার এতদিন পর খবরটি প্রকাশ হচ্ছে এটাই দেশবাসীর জন্য সান্ত্বনা। যাহোক, তখন দুদক ও ইসি জেনেও চুপ ছিল, সেটাও গর্হিত অপরাধ। এখন দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কমিশন কী ব্যবস্থা নেয়, সেটাও দেখার বিষয় বলে জানান তিনি।

বেনামে শুল্কমুক্ত কোটায় গাড়ি নিয়ে জালিয়াতি

দুদকের তদন্তে জালিয়াতির আরেকটি বড় ঘটনা ধরা পড়ে। শেখ হাসিনা মাগুরা-১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল আকবরের শুল্কমুক্ত কোটা ব্যবহার করে বেনামে দুই লাখ ৩০ হাজার ইউরো মূল্যে (গাড়ি আমদানির এলসির বিপরীতে ব্যাংক থেকে পরিশোধিত এক কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা) একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি আমদানি করেন। এতে ‘সুধা সদন’, বাড়ি নম্বর ৫৪, রোড নম্বর ৫, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ঢাকার আবাসিক ঠিকানা ব্যবহার করে গাড়ি রেজিস্ট্রেশন (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৬৩৬৪) করান তিনি এবং নিজে গাড়িটি ব্যবহার করেন। প্রফেসর ডা. সিরাজুল আকবরের আয়কর নথিতে কিংবা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার দাখিল করা হলফনামায় ওই গাড়ির কথা উল্লেখ নেই কিংবা কোনো তথ্যও দেওয়া হয়নি।

তদন্তে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ অনুযায়ী যেভাবে মিথ্যা হলফনামা প্রদান ও বিপুল সম্পদ গোপন করার দায়ে শেখ হাসিনার প্রার্থিতা বাতিল করার কথা, সেটা জেনেও বিষয়টি চেপে রেখে সাজানো নির্বাচনে তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করে। তৎকালীন সিইসি ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের জ্ঞাতসারে ওই কমিশন শেখ হাসিনার মিথ্যা হলফনামা গ্রহণ করে। প্রার্থীর অযোগ্য শেখ হাসিনাকে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন শুধু এমপি হিসেবে বিজয়ীই ঘোষণা করেনি, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণের সুযোগ করে দেয়; যা ছিল গর্হিত অপরাধ।

ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদকের প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে

দুর্নীতি দমন কমিশন পুরো বিষয়টি অনুসন্ধান এবং সত্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান করে রিপোর্ট তৈরি করেছে। কমিশন তাদের অনুসন্ধান ও তদন্তের পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে গত ২২ মে বর্তমান সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে পত্রের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠিয়েছে। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। দুদক মনে করে, মিথ্যা হলফনামা চেপে গিয়ে শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত ঘোষণা করার ঘটনায় ওই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রার্থিতা বাতিলপূর্বক তার সংসদ সদস্য পদ, প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে মিথ্যা হলফনামার জন্য তাকে আইনের কাছে সোপর্দ করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযাগ করলে তিনি ব্যস্ত আছেন জানিয়ে কমিশন সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে শেখ হাসিনার বিষয়ে একটি চিঠি পাওয়ার কথা জানান। আমার দেশকে তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া সম্পদের তথ্য গোপনসংক্রান্ত একটা চিঠি আমরা পেয়েছি। আরপিও ও আইনের সঙ্গে কী ধরনের সাংঘর্ষিক আছে, সেটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত পেতে কতদিন লাগতে পারে জানতে চাইলে সচিব জানান, আজও হতে পারে, পরশু কিংবা এক সপ্তাহ লাগতে পারে।

দুদকের সুপারিশ

দুর্নীতি দমন কমিশন তার সুপারিশে অসৎ উদ্দেশ্যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যের ঘোষণা দিয়ে এবং অবৈধ ও অসাধু উপায়ে অর্জিত এবং জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত দুই কোটি ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯০ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজুর সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ২০০৮-পরবর্তী সময়ে কোনো অবৈধ ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন কি না, তা অনুসন্ধান করার সুপারিশ করেছে।

দুদক তার সুপারিশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় ২১ দশমিক ৯১ একর স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন, ক্রয়কৃত জমির মূল্য কম দেখানো এবং এক কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যে ক্রয়কৃত গাড়ির তথ্য গোপনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। জানা গেছে, দুদক থেকে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়।

যা আছে আরপিওতে

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ অনুসারে [আরপিও ১৪(৩)(সি)] হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থী তথ্য না দিলে বা হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে রিটার্নিং অফিসার নিজ উদ্যোগ অথবা কোনো ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত তদন্ত পরিচালনা করতে পারবেন এবং কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। এ ছাড়াও হলফনামায় প্রদত্ত কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হলে তা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

শেখ হাসিনার সম্পত্তি

দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে গোপালগঞ্জের খাটরা, খুলনার দিঘলিয়া, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এবং বালাডাঙ্গায়। কেনা স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে খুলনার দিঘলিয়া, টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি এবং রংপুরের পীরগঞ্জের উজিরপুরে। দাখিল করা সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি ৫ দশমিক ১৯ একর এবং নিজ নামে অর্জিত ৪ দশমিক ১১৮ একর অর্থাৎ ৯ দশমিক ৩০৮ একর। দুদক তদন্ত করে উত্তরাধিকার সূত্রে শেখ হাসিনার প্রাপ্ত জমির পরিমাণ ১১ দশমিক ৪৪৫ একর পেয়েছে। শেখ হাসিনার নিজ নামে কেনা স্থাবর সম্পত্তি দুদক পেয়েছে ১৬ দশমিক ৯৬৬ একর। তদন্ত করে দুদক শেখ হাসিনার নিজ নামে অর্জিত মোট সম্পদ পেয়েছে ১১ দশমিক ৪৪৫+১৬ দশমিক ৯৬৬=২৮ দশমিক ৪১১ একর। শেখ হাসিনা নিজ নামে জমি কিনেছেন খুলনা, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, পটুয়াখালীর সোনাতলা (কলাপাড়া), রংপুরের উজিরপুর, পীরগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায়।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের বিস্তারিত

শেখ হাসিনার মিথ্যা হলফনামা ও সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের বিষয়টি তদন্ত করে দুদক যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে আছে স্থাবর সম্পত্তির প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রে ১১ দশমিক ৪৪৫ একর এবং ওই সময়ে নিজ নামে ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০ টাকা মূল্যে আরো ১৬ দশমিক ৯৬৬ একর জমি কিনেছেন। তদনুযায়ী তার অর্জিত স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৪১১ একর। কিন্তু ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনে তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে উত্তরাধিকার সূত্রে ৫ দশমিক ১৯ একর জমি এবং ক্রয়সূত্রে ১০ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩০ টাকা মূল্যে অর্জিত ৪ দশমিক ১১৮ একর হিসাবে মোট ৯ দশমিক ৩০৮ একর জমির তথ্য দেন। পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেখ হাসিনা সম্পদ বিবরণীতে ১৯ দশমিক ১০ একর স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন এবং ক্রয়কৃত জমির মূল্যে ২৩ লাখ ১২ হাজার ৬৮০ টাকা অসৎ উদ্দেশ্যে কম দেখিয়েছেন, যা তার আয়ের বৈধ উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

দুদকের তদন্ত অনুযায়ী ২০০৭ সালে শেখ হাসিনার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ১৫৪ টাকা। কিন্তু ওই সময়ে দুদকে দাখিলকৃত বিবরণী অনুযায়ী তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ২৪ লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৪ টাকা। এ হিসাবে তিনি এক কোটি ৯৩ লাখ ২২ হাজার ৮১০ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য অসৎ উদ্দেশ্যে গোপন করেছেন, যা তার আয়ের বৈধ উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

শেখ হাসিনার স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে সম্পদের পরিমাণ পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা হলেও দুদকে দাখিল করা বিবরণী অনুযায়ী তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৬৭৪ টাকা। এক্ষেত্রে দুদকের কাছে দুই কোটি ১৬ লাখ ৩৫ টাকা ৪৯০ টাকার অর্থ গোপন করেছেন। অসৎ উদ্দেশ্যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়কাল বিবেচনা করলে তার জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। শেখ হাসিনার আয়কর নথি অনুযায়ী ২০০৭-০৮ করবর্ষে স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৫ দশমিক ১২ একর। এক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নে ২৩ দশমিক ২৯ একর সম্পত্তি কম দেখিয়েছেন। আর ক্রয়কৃত জমির মূল্য কম দেখানো হয়েছে ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ১০ টাকার। একই ভাবে তিনি আয়কর রিটার্নে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ কম দেখিয়েছেন এক কোটি ৯৭ লাখ ৫২ হাজার ৪৫৬ টাকার। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে আয়কর রিটার্নে দুই কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৭৬ টাকা কম দেখিয়ে অপরাধ করেছেন।

শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে হলফনামায় ৬ দশমিক ৫০ একর জমি দেখালেও ওই সময় তার মোট জমির পরিমাণ ছিলে ২৮ দশমিক ৪১১ একর। এ হিসাবে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় ২১ দশমিক ৯১ একর জমির তথ্য গোপন করেছেন। একই সময়ে তথ্য গোপন করে ক্রয়কৃত জমির দাম ৩১ লাখ ৯১ হাজার টাকা কম দেখিয়েছেন। তিনি মাগুরা-১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল আকবরের সংসদ সদস্য পদের শুল্কমুক্ত কোটা ব্যবহার করে বেনামে ২ লাখ ৩০ হাজার ইউরো মূল্যে (বাংলাদেশি মুদ্রায় এক কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা) একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি আমদানি করে ধানমন্ডির সুধা সদনের ঠিকানা ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করেন (যার নম্বর, ঢাকা মেট্রো ৭-১১-৬৩৬৪) এবং নিজে তা ব্যবহার করেছেন। সিরাজুল আকবরের আয়কর নথিতে কিংবা নির্বাচনি হলফনামায় ওই গাড়িসংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। ওই গাড়ি সিরাজুল আকবর কখনো ব্যবহার করেননি বলে দুদকের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা জেনেছেন বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার এক কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের মার্সডিজ গাড়ির তথ্য গোপন করে হলফনামায় অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি বেনামে গাড়িটি কিনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

হলফনামায় মিথ্য তথ্য দেওয়ায় এমপিত্ব বাতিলের নজির

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তথ্য গোপন করলেও নির্বাচন কমিশন ওই সময় আমলে নেয়নি। পরে ওই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৫ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবুল কাশেম বিজয়ী হন। পরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির মাহমুদুল হাসান হলফনামায় তথ্য গোপনের বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। শুনানির পর ২০১২ সালে আদালত আবুল কাশেমের প্রার্থিতা বাতিল করে মাহমুদুল হাসানকে বিজয়ী ঘোষণা করে। মাহমুদুল হাসান ২০১২ সালে শপথ নিয়ে ওই সংসদের বাকি মেয়াদ এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ায় ভোলা‑৩ (লালমোহন‑তজুমদ্দিন) আসনের সংসদ সদস্য জসীম উদ্দিনের এমপি পদ বাতিল করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে জয়লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পাঁচ বছরের সময় পূর্ণ হওয়ার আগে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। হাইকোর্ট পরে তার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করে এবং সেই ভিত্তিতে তার সংসদ সদস্য পদও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল ওই আসনে আওয়ামী লীগের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন জয়ী হন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদকের আরো মামলা

ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট জালিয়াতির অভিযোগে শেখ হাসিনা ও পরিবারের ছয়জনসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১২ জানুয়ারি দুদক মামলাটি দায়ের করে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন মামলা বাতিল করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য আগামী ১৫ জুলাই দিন ধার্য করা হয়েছে। বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগে ২০০৭ সালে তেজগাঁও থানায় শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এ ছাড়াও গত ১১ মার্চ রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির অভিযোগে হাসিনা-রেহানা, পুতুল-টিউলিপসহ পরিবারের সাতজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার জন্য আদালাতে আবেদন করে দুদক। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামে বিপুল অর্থ লোপাটের অভিযোগ থাকায় তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের আবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামে প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা লোপাটের একটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে অনুসন্ধানাধীন রয়েছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। দুদক জানায়, শিগগির দুদক শেখ হাসিনার নামে মামলা দায়ের করবে।

সূত্র : আমার দেশ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!